শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৬

Dignity of Hezbollah and Sojourn of a Hezbollah -by Abu Kaiser Mohammad Salahuddin

HEZBOLLAH
Allah and His whole creation is the sign of Dignity of Hezbollah
Those who submits to Allah and obedient to Him are in Sojourn of Hezbollah

Dignity of Hezbollah
Hezbollah is not a party, not an organization,
Nor it is any co-operative.
Political aims, cultural propaganda, acquisition of wealth
– None of these are its relatives.

Each and every human, trees and the plants, animals and the birds –
Are all “Ayatollah” - the signs of Allah.
Thus each and every human of each and every strata and layer
Belongs to Hezbollah.

Each and every human is originally good, auspicious –
Divine spark of the Creator.
Cycles of circumstances sink the souls in darkness.

Whatever there are in the Books
Exposes the identities of the souls –
Groaning for returning to our original habitat,
The eternal home of love for Allah,
Before this perishable body perishes into the soils.

Sojourn of a Hezbollah
I am that bare-footed cavalier
Whose dagger is never in the scabbard,
The  weapon is sharpened by my sweat and blood,
The dagger that instantly and instinctively  differentiate
Between a the friend and the foe of humanity.

I am that traveller of twilight zone
Who never fully quench unfathomable thirst
By sweet fragrant water from the pitcher –
Lest I should be dozing in the slumber room
Of self-deception and self-aggrandizement.

I am marooned into the illusion of restful destination,
Which is far, oh me !
The oasis I discern
Embedded on love and compassion
Is still far !

Long miles I have to go,
I have to run with nostalgic melancholia and hope,
Before I go to sleep !

The waves of probabilities undulating in to seeming reality
I dream – a rosy dream,
My blood – a blue blood,
Drizzle into my sweat and efforts
Between “Kaza” and “Qadr” – the dimensions of divine life,
Blizzard by free-will.
I am in a painstaking journey,
Both of my legs are in gangrene,
Yet the other day I saw in the twinkle of an eye
When the hot  ray of the sun reflected on my wounds
Seventy thousand servants of Heaven bowed down before me,
This is the mystery, the door and the destination
Of a traveller in the Divine path
Who finishes the self in Divine Love.
So be it ! Let it be my endless song of life,
The endless and continuous surrender

And devotion to His Will !

হিজবুল্লাহর শান এবং হিজবুল্লাহর সফর -আবু কায়ছার মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন

হিজবুল্লাহ
আল্লাহ এবং তাঁর সমগ্র সৃষ্টি মিলেই হিজবুল্লাহর শান
আল্লাহ এবং তাঁর নিকট সমর্পিত-অনুগত বান্দা মিলেই হিজবুল্লাহর সফর

হিজবুল্লাহর শান

হিজবুল্লাহ কোন দল নয়, কোন সংগঠন নয়,
কিছু লোকের সমবায়ও নয়;
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সাংস্কৃতিক প্রচারণা, বিত্তবৈভব অর্জন –
কোনটার সাথেই এর কোন সম্পর্ক নেই।
সমগ্র সৃষ্টির প্রতিটি মানুষ,
এমনকি ভাষাহীন বৃক্ষলতা, প্রাণীকূল,
আল্লাহর এক একটি স্মারক চিহ্ন “আয়াতুল্লাহ”।
মহত্তম সৃষ্টি হিসাবে মানুষ তথা সমাজের
প্রতি স্তরের প্রতিটি মানুষই হিজবুল্লাহ।
প্রতিটি মানুষই মূলতঃ  ভাল, মংগলময়
– বিধাতার ঐশী স্ফুলিংগ;
অবস্থাচক্রই তার আত্মার মলীনতার কারণ।
গ্রন্থের পংতিমালায় যা কিছু আছে
তা মানুষেরই আত্মার পরিচয় – আর্তনাদ
নিজ  বাসভূমি আল্লাহর ইশকের চিরকালীন
নিকুঞ্জে ফিরে যাওয়ার আকুতি –
এ মরদেহ মাটিতে মেশার আগেই।


হিজবুল্লাহর সফর

আমি সেই নগ্নপদ ঘোড় সওয়ার
যার দুধারী কৃপাণ কখনো কোষবদ্ধ হয়না,
স্বেদ ও  শোনিতে ঘষে নেয়া যে কৃপাণ
মূহুর্তে বুঝে নেয় মানবতার শত্রু আর মিত্রের ফারাক।

আমি সেই মুসাফির
যে কখনো সতৃষ্ণ কন্ঠ সম্পূর্ণ  ভিজিয়ে নেয়না
পরিপূর্ণ সোরাহীর জলে।
যাকে মঞ্জীল বলে মনে হয়,
যাকে মনে হয় স্নেহ ছায়া নীড়,
সেখানে পৌছে দেখি এখনো অনেক পথ বাঁকী,
এখনো চলতে হবে বহু দূর,
অহল্যার রাজপথে তাই আমার ক্ষীপ্র বিচরণ।
রক্ত বিন্দু ফেটে পড়ে স্বেদ বিন্দু হয়ে,
চোখের সকেটে জমে আছে বিনিদ্র রাতের কালি।
হ্রদয়হীনতায় চলতে গিয়ে আমার দুপায়ে গ্যাংরীন।
তবুও সেই কর্দমাক্ত ক্ষয়ে যাওয়া পদ নখে সেদিন দেখলাম
তপ্ত সূর্যের প্রতিফলনে ঝলসে উঠে যে জ্বালওয়া,
তাতেই মুর্ছা গেল স্বর্গের সত্তুর হাজার হুর পরী গেলমান,
খসে পড়ল তাদের বাজু-বন্ধন,
দীদার প্রার্থী পথিকের সেইতো গোপন রহস্য,
তার দ্বার ও মোকাম।
তথাস্ত। এই হোক মোর জীবনের অরিন্দম গান,

ক্রমাগত আত্মমগ্ন, আত্মসমর্পন।।

সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

হযরত শরফুদ্দিন আহমদ বিন ইহইয়া মানেরি রঃ


হযরত শরফুদ্দিন আহমদ বিন ইহইয়া মানেরি রঃ এর মাযার
হিন্দুস্তানের বিহার-এর রাজধানী পাটনা থেকে ২৯ কিঃমিঃ দূরে মানেরে অবস্থিত

মাখদুমে মুলক হযরত শরফুদ্দিন আহমদ বিন ইহইয়া মানেরি আলাইহিমার রাহমাহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ মহান সূফি ব্যক্তিত্ব। তিনি ফেরদৌসিয়া তরিকার একজন মহান শাইখ ছিলেন। ফেরদৌসিয়া তরিকার দিক দিয়ে তিনি ঐতিহ্যবাহী মাইজভান্ডারিয়া তরিকার উর্ধতন শাইখ হযরম মাখদুম শাহ মুনইম পাকবাজ আলাইহির রাহমার এর উর্ধতন শাইখ ছিলেন। তিনি আজীবন সুন্নাতে রাসূলের উপর অটল ছিলেন। তিনি প্রখরকশফ ও কারামত সম্পন্ন অতি উঁচুমানের অলি ছিলেন,যাঁর তাঁর বেলায়ত ও উচ্চ মর্যাদার ব্যাপারে সকলই একমত । তাঁর কামালিয়াত বর্ণনাতীত। তাঁর জীবন চরিত অতি সংক্ষেপে পাঠকদের উদেশ্যে তোলে ধরলাম।

নাম ও বংশ পরিচিতিঃ
তাঁর নাম আহমদ ও উপাধি শরফুদ্দিন। তিনি মাখদুমুল মুলকনামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতার নাম হযরত ইহইয়া। তাঁর পিতা একজন সাহেবে কারামত অলি ছিলেন। তাঁর পরদাদা মাওলানা মুহাম্মদ তাজুদ্দিন আলাইহির রাহমাহও একজন খ্যাতনামা আলেম ছিলেন। মাওলানা মুহাম্মদ তাজুদ্দিন সিরিয়ার আল-খলিলনামক শহর থেকে ভারতের বিহারস্থ মানেরে আগমন করেন। হযরত শরফুদ্দিন মানেরি পিতার দিক থেকে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর চাচা যুবাইর বিন আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর আর তাঁর মাতা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর বংশধর । তাঁর নানা শাহাবুদ্দিন জগজটও সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সূফি ছিলেন। (মাওলানা আবুল হাসান,‘তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত’,কাকুরি অপসেট প্রেস,লাখনু,প্র.১৪২৭হি.,খ.৩,পৃ.১৭৭-১৭৮)

শুভ জন্মক্ষণঃ
তিনি সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ এর সময়কালে শাবান মাসের শেষ শুক্রবার ৬৮৫/৬৬১ হিজরিতে বিহারের মানেরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর আরো তিন ভাই রয়েছে। তাঁরা হলেন-শাইখ খলিলুদ্দিন,শাইখ জলিল উদ্দিন ও শাইখ হাবিবুদ্দিন।(তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত, খ.৩,পৃ.১৭৯;আব্দুল হাই হাসানি,‘নুজহাতুল খাওয়াত্বির ওয়া বাহজাতুল মাসামি ওয়ান নাওয়াজির’,দারু ইবন হাযিম,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪২০হি.,খ.২,পৃ.১৪৩) মানেরে একজন প্রসিদ্ধ সাহেবে কারামত ও কশফ অলি ছিলেন। হযরত শরফুদ্দিন মানেরির পিতা ইহইয়া মানেরি তাঁর নিকট যাতায়ত করতেন। তিনি ওই অলির নিকট গেলে,তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। একদা হযরত ইহইয়া মানেরি তাঁর নিকট গেলে,ওই অলি দাঁড়ান নি। এ অবস্থা দেখে ইহইয়া মানেরি মনে মনে ভাবতে লাগলেন,ব্যাপার কী ? ওই অলি তাঁর মনের প্রশ্ন জানতে পেরে বললেন,আমি আপনার পৃষ্ঠে থাকা ব্যক্তিকে সম্মান করতাম;কিন্তু তিনি এখন তাঁর মায়ের পেটে চলে গেছেন। এ জন্য আমি আজ আপনার সামনে দাঁড়াই নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,তিনি মাদারজাত অলি । তিনি জন্ম গ্রহণ করার পর তাঁর মাতা তাঁকে অজু করেই দুধ পান করাতেন।(আব্দুর রহমান চিশতি,‘মিরাতুল আসরার’,জিয়াউল কুরআন পাবলিকেন্স,লাহুর,প্র.১৪১৪ হি.,পৃ.৯২৮)

শিক্ষাজীবনঃ
তিনি তৎকালীন নিয়মানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সমাপ্ত করেন। তৎকালে সিলেবাসভুক্ত কিতাবসমূহ সম্পূর্ণ পড়ানো হত। সিলেবাসের মধ্যে কিছু অভিধান গ্রন্থও অন্তভুক্ত ছিল। এ স্তরে তিনি কী কী কিতাব অধ্যয়ন করেছেন এবং কারা কারা তাঁর শিক্ষক ছিলেন, এ ব্যাপারে কোন তথ্য জানা যায় নি।(তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত,খ.৩,পৃ.১৭৯) তবে তিনি নিজেই স্বীয় মাদানুল মায়ানিগ্রন্থে বলেছেন-বাল্যকালে আমার শিক্ষক আমাকে অনেকগুলো কিতাব পড়িয়েছেন যেমন মাসাদির’,‘মিফতাহুল লুগাতইত্যাদি। মিফতাহুল লুগাত’(অভিধান গ্রন্থ) এর এক খ- আমাকে শিখিয়েছেন। এটি তারা বারংবার মুখস্থ শুনতেন অথচ এটি বার বার শোনার চেয়ে পবিত্র কুরআন পড়ানো প্রয়োজন ছিল।”(মাদানুল মায়ানি,পৃ.৪৩) নিজ গ্রামে তিনি মাধ্যমিক স্তরের জ্ঞানার্জন সমাপ্ত করেন। এরপর সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের অনুরোধে মাওলানা শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা আলাইহির রাহমাহ বাংলাদেশের সোনারগাঁও আসার সময়ে পথিমধ্যে মানেরে কিছুদিন অবস্থান করেন। মানেরবাসী জানতে পারল যে,দিল্লি থেকে একজন বড় আলেম তাদের গ্রামে অবস্থান করছেন। এ সময়ে শাইখ শরফুদ্দিন মানেরি তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও তাকওয়া দেখে প্রভাবিত হয়ে বললেন,এ ধরণের বাআমল ও মুত্তাকি আলেম থেকে দীনি জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। তারপর তিনি স্বীয় পিতা মাতা থেকে অনুমতি নিয়ে হযরত শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার সাথে জ্ঞানার্জনের জন্য বাংলার সোনারগাঁয়ে চলে আসেন।(শাইখ আব্দুর রহমান চিশতি,মিরাতুল আসরার,পৃ.৯২৮) তিনি সেখানে স্বীয় উস্তাদের নিকট প্রচলিত দীনি কিতাবসমূহ অধ্যয়ন শেষ করেন। জ্ঞানর্জনের প্রতি তাঁর গভীর মনযোগ এবং উপযুক্ততা দেখে স্বীয় উস্তাদ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর উস্তাদ তাঁর খাবার তাঁর রুমে পাঠিয়ে দিতেন,যাতে তাঁর সময় নষ্ট না হয়। শরফুদ্দিন মানেরি দীনি কিতাব শেষ করার পর তাঁর উস্তাদ শাইখ আবু তাওয়ামা তাঁকে বললেন,তুমি পার্থিব জ্ঞান যেমন রসায়ন ইত্যাদিও আমার থেকে শিখে নাও। তিনি বললেন,হুজুর,দীনি জ্ঞানই আমার জন্য যথেষ্ট।(তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত,খ.৩,পৃ.১৮২)

বৈবাহিক অবস্থাঃ
হযরত শরফুদ্দিন আহমদ মানেরির উপযুক্ততা দেখে তাঁর উস্তাদ হযরত আবু তাওয়ামা স্বীয় কন্যাকে তাঁর সাথে বিয়ে দিলেন। তিনি সস্ত্রীক সুদীর্ঘ সময় সোনারগাঁয়ে অবস্থান করেছেন এবং সেখানে তাঁর তিন ছেলে জন্ম গ্রহণ করেন; কিন্তু তাঁর বড় ছেলে শাইখ যকি উদ্দিন ছাড়া বাকী দুই ছেলে এবং স্বীয় স্ত্রী সোনারগাঁয়ে অবস্থানকালে ওফাত লাভ করেন। (নুজহাতুল খাওয়াত্বির, খ.২,পৃ.১৪৩)

মানেরে প্রত্যবর্তনঃ
সোনারগাঁয়ে অধ্যয়নকালে তাঁর আত্মীয় স্বজন থেকে অনেক চিঠি এসেছে,যার একটিও তিনি পড়েননি শুধু এ কারণে যে,চিঠিতে এমন কোন খবর থাকতে পারে,যা তাঁর অধ্যয়নে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তিনি সব চিঠি একটি থলেতে জমা করে রেখেছেন ; কিন্তু পরবর্তীতে এগুলো আর অধ্যয়ন শেষে পড়া হয় নি ; বরং দীর্ঘ সময়ের পর এগুলো পড়েছেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন যে,পরবর্তীতে যখন তিনি থলে থেকে চিঠিগুলো পড়ার জন্য নিলেন,তখন তিনি প্রথম চিঠিতেই খবর পেলেন যে,তাঁর পিতা ওফাত লাভ করেছেন। পিতার ওফাতের খবর পেয়ে তিনি মানেরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অবশ্য তিনি মানেরে পৌঁছার অনেক আগেই তাঁর পিতা ওফাত লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি স্বীয় শ্বশুর ও উস্তাদ শাইখ আবু তাওয়ামা থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁর বড় ছেলেকে নিয়ে ৬৯০/৯৯১ হিজরিতে মানেরে চলে গেলেন। তখনও সেখানে তাঁর মা জীবিত ছিলেন। (নুজহাতুল খাওয়াত্বির,খ.২,পৃ.১৪৪)

আধ্যাত্মিক জীবনঃ
অগাধ জাহেরি জ্ঞানভান্ডর আয়ত্ব করেও তিনি অতৃপ্তিতে ভুগতেন। ফলে অচিরে আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জনের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাই তিনি তাঁর মাকে বললেন,আম্মু,আমার পরিবর্তে আমার সন্তান যকি উদ্দিনকে আপনার সাথে রাখুন। আমি দিল্লি যাবো। এরপর তিনি দিল্লির অনেক মাশায়েখের নিকট গেলেন;কিন্তু কেউ তাঁর মনঃপুত হলো না। তিনি বললেন,‘পীর-মুরিদি যদি এ রকম হয়,তাহলে আমিও পীর।অতঃপর তিনি সুলতানুল মাশায়েখ খাজা নিজামুদ্দিন আলাইহির দরবারে গেলেন,তিনি তাঁকে সম্মান করে আপ্যায়ন করলেন এবং তাঁর সামনে একটি পানের থালাও পরিবেশন করলেন। এরপর সুলতানুল মাশায়েখ তাঁকে আধ্যাত্মিকতার দীক্ষা না দিয়ে বিদায় দিয়ে তাঁর মুরিদদেকে বললেন,‘উনি এমন একটি বাজপাখি,যা আমাদের জালে আটকা পড়বে না।তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তাঁর মনে উদ্রেক হলো,“শাইখ যদি এ রকম হয়,তাহলে আমিও শাইখ।অপর বর্ণনায় রয়েছে,শাইখ শরফুদ্দিন মানেরি খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া আলাইহির রাহমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন ;তবুও তিনি তাঁকে বিদায় দিলেন। কারণ তিনি জানতেন যে, খাজা নজিবুদ্দিন ফেরদৌসি শরফুদ্দিন মানেরির অপেক্ষায় রয়েছেন এবং তিনি সেই তরিকার খলিফা হবেন। মির সাইয়িদ আশরাফ জাহাঙ্গির সিমনানি আলাইহির রাহমাহ বলেন,“ শরফুদ্দিন মানেরি খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবার থেকে বের হয়ে যাবার সময় বলেছেন,দাঁড়াও! ফকিরের দরবার থেকে খালি হাতে যেয়ো না। চিশতিয়া খান্দানের সম্পদ সেমাসাফাইনিয়ে যাও। তিনি সবিনয় তা গ্রহণ করেছেন। তাই ফেরদৌসিয়া তরিকার সম্পদ সেমাসাফাহলো চিশতিয়া তরিকার তোহফা।”(মির সাইয়িদ আশরাফ জাহাঙ্গির সিমনানি,‘লাতাইফে আশরাফি’,প্রকাশনী:জামে আশরাফ,ফয়জাবাদ,ভারত, খ.১ম,পৃ.৫৮৫) অন্য বর্ণনায় রয়েছে,তিনি খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবারে পৌঁছানোর পূর্বেই খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া ওফাত লাভ করেছেন। প্রথম অভিমতই অধিম বিশুদ্ধ। তিনি সেখান থেকে ফিরে পানিপথের প্রখ্যাত শাইখ বু আলি কলন্দর আলাইহির রাহমার দরবারে আসেন। তিনি তাঁর মস্তি হালত দেখে দরবার থেকে বের হয়ে গেলেন এ মনে করে যে,তিনি তো এ অবস্থার কারণে আমাকে তারবিয়াত বা দীক্ষা দিতে পারবে না। দরবার থেকে বের হবার সময় শরফুদ্দিন বু আলি কলন্দরদ তাঁকে বললেন,“হেরা গুহায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরজা খুলেছে আর তোমার দরজা খুলবে রাজগরে।অর্থাৎ হেরা গুহায় রাসূলে করিমের উপর ওহি নাযিলের মাধ্যমে নবুয়ত প্রকাশ পেয়েছে আর তোমার বেলায়তের দ্বার উন্মোচন হবে রাজগীরের অরণ্যে। তিনি নিরাশ হয়ে নিজ ঘরে ফিরে এলে,তাঁর বড় ভাই তাঁকে বললেন,তুমি খাজা নজিবুদ্দিন ফেরদৌসির দরবারে যাও । তিনি বললেন,আমি যেহেতু দিল্লির কুতুব(খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া) থেকে ফিরে এসেছি,তাহলে অন্যের কাছে কীভাবে যাব ? তাঁর বড় ভাই বললেন,আউলিয়ায়ে কিরামের ব্যাপারে এ ধরণের কথা বলা উচিত নয়। বড় ভাইয়ের অনুরোধে তিনি খাজা নজিবুদ্দিন ফেরদৌসির দরবারে যাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। দরবারের কাছাকাছি পৌঁছুলে তাঁর অন্তরে একটু ভীতির উদ্রেক হলো। ভাবতে লাগলেন,কী ব্যাপার ? ইতিপূর্বে অনেক দরবারে গেলাম এমনকি খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবারেও;কিন্তু এ রকম তো আর লাগে নি। এখানে নিশ্চয় কোন রহস্য আছে। তিনি দরবারে প্রবেশ করে খাজা নজিবুদ্দিনের সামনে উপস্থিত হলে,তিনি বললেন,“তোমার মুখেও পান, রুমালেও পান আর বলছো আমিই শাইখএ কথা শুনে তিনি মুখ থেকে পান ফেলে দিয়ে তাঁর সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলে,তিনি তাঁকে বাইয়াত করান। তারপর তাঁকে তরিকায়ে ফেরদৌসিয়ার সকল অযিফা শিখিয়ে দিলেন এবং ওয়াহদাতুল ওজুদ’(শাইখে আকবর মুহিউদ্দিন ইবন আরবির একটি দার্শনিক মতবাদ)সহ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষা দিলেন। অতপর এ তরিকার খিরকা ও খেলাফত প্রদান করলেন। শরফুদ্দিন মানেরি বললেন,হুজুর,এটি অনেক বড় দায়িত্ব। আমি কীভাবে সামাল দিব ? হুজুর বললেন,এ ইজাযতনামা আমি তোমার জন্য রাসূলে করিমের নির্দেশে লেখেছি। তোমার উপর আমার মাশায়েখদের বেলায়তের শক্তি ও ফয়েজ থাকবে। এ ব্যাপারে তুমি কোন চিন্তা কর না। এরপর তিনি শরফুদ্দিনকে এ কথা বলে বিদায় জানালেন যে,তুমি পথিমধ্যে যদি কোন সংবাদ শুনে থাক,তাহলে এখানে আর ফিরে আসবে না। তিনি কিছুদূর যাবার পর খবর পেলেন যে,তাঁর পীর খাজা নজিবুদ্দিন আলাইহির রাহমাহ ওফাত লাভ করেছেন। তিনি পীরের দরবারে ফিওে যেতে চাইলে,পীরের নির্দেশ স্মরণ হয়। এ জন্য তিনি সামনে অগ্রসর হলেন। (মিরাতুল আসরার,পৃ.৯২৮-৯৩০; তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত,খ.৩,পৃ.১৮৪-১৮৫) তিনি তরিকতের দীক্ষা গ্রহণ করে বাড়িতে আসার সময় পীরের দেয়া ইজাযত নামাপথিমধ্যে তাঁর ভাইকে দিয়ে রাস্তার পার্শ¦স্ত জঙ্গলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। জঙ্গলটি ছিল বেহিয়ানামক স্থানে,যা মানের থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাঁর ভাই ও সফরসাথীরা জঙ্গলে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁকে আর পায় নি। পীরের দেয়া ইজাযতনামা ও তার্বারুকাতসমূহ তাঁর ভাই স্বীয় মাকে প্রদান করলেন। কিছুদিন পর মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হলে, তাঁর মা ভীষণ চিন্তিত হলেন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। সন্তানের জন্য একজন মায়ের এ অবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ তাঁর আদরের সন্তান এমন অরণ্যে রয়েছেন, যেখানে নেই কোন বৃষ্টিরোধক , নেই কোন খাবার ব্যবস্থা। তাৎক্ষণিক হযরত শরফুদ্দিন মানেরি স্বীয় ঘরের উঠানে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর মা তাঁকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন এবং বলেন, ভেতরে এসো। তিনি বললেন,আপনি বাইরে এসে দেখুন, এ বৃষ্টিতে আমার অবস্থা কী হয়েছে। তাঁর মা বাইরে এসে দেখেন,তাঁর ছেলের কাপড় একেবারে শুকনো এবং তিনি যে স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন,সেখানে একটুও বৃষ্টি হচ্ছে না। তিনি তাঁর মাকে বললেন,আল্লাহ তায়ালা আমাকে এভাবেই হেফাযত করেন। তাই আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং আমাকে আল্লাহর রাস্তায় সোপর্দ করে দিন। অতপর তাঁর মা তাঁকে আল্লাহর রাস্তায় সোপর্দ করে দিলে,তিনি পুনরায় জঙ্গলে চলে গেলেন। পরবর্তীতে তাঁকে রাজগীরের জঙ্গল-উপত্যকায় দুএকবার দেখা গেছে;তবে কেউ তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে পারেনি। তিনি জঙ্গলে দীর্ঘ বার বছর গাছের পাতা খেয়ে রিয়াযত বন্দেগিতে মশগুল ছিলেন। রাজগড়ের পাহাড়ে একটি গরম পানির র্ঝণা রয়েছে,যার পাশে শরফুদ্দিন মানেরির সাধনাস্থল রয়েছে,যা আজও মাখদুম কুন্ডনামে পরিচিত। তিনি এখানেই কামালিয়াত অর্জন করেছেন। অলিভক্তগণ এখনো এটি যিয়ারত করে থাকেন। একদিন তাঁর এক একনিষ্ট মুরিদকে কোন প্রশ্নের উত্তরে বলেন,‘আমি যে রিয়াযত করেছি,তা যদি পাহাড় করত,তাহলে পাহাড় পানি হয়ে যেতো;কিন্তু শরফুদ্দিনের কিছুই হয়নি।রিয়াযতকালে অনেক বছর পর্যন্ত তিনি রিজালুল গাইববা অদৃশ্য ব্যক্তি ছিলেন। শেষের দিকে রাজগীরের মাখদুম কন্ডবা রিয়াজতস্থলে তাঁর সাথে কতিপয় ব্যক্তির সাক্ষাৎ হয়। এ খবর জেনে খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার এক খলিফা মাওলানা নিজামুদ্দিন যিনি নিজামে মাওলানামে খ্যাত তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হযরত শরফুদ্দিন মানেরির সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য প্রায় ওই মাখদুম কুন্ডে যেতেন। তাঁদেরকে একদিন হুজুর বলেন,এ স্থান বিপদজনক।এখানে তোমাদের আসার ব্যাপারে আমার চিন্তা হয়। তাছাড়া কষ্ট করে এখানে এনো না; বরং শহরের জামে মসজিদে আমি জুমার নামাজ আদায় করতে আসলে,সেখানেই সাক্ষাৎ কর। তাঁরা এ খবর শুনে খুবই খুশি। তাঁরা শহরের জামে মসজিদ সংলগ্ন একটি ছোট খানকা তৈরি করেন। তিনি জুমার নামাজের পর এ হুজরায় বসে ভক্তবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করে পুনরায় জঙ্গলে চলে যেতেন;তবে মাঝেমধ্যে এখানে দুএক একদিন থেকে যেতেন। হযরত নিজামে মুলকের অনুরোধে বিহারের তৎকালীন সুবেদার মজদুল মুলক এটিকে ভেঙ্গে বড় আকারে তৈরি করে দেন। পরবর্তীতে হুজুর এ খানকায় বেশিরভাগ সময় অবস্থান করা শুরু করলে,ভক্তবৃন্দের আনাগোনা ভীষণভাবে বেড়ে গেল। তারপর সুলতান মুহাম্মদ শাহ তুগলকের নির্দেশে বিহারের সুবেদার পাথর দিয়ে খানকাটি পুননির্মান করে দেন। তারপর সুলতান ফিরূজ শাহ ওই খানকার ব্যয়ভার নির্বাহরে জন্য একটি গ্রাম ওয়াক্ফ করে দেন। এক বর্ণনায় রয়েছে, হুজুর ওয়াক্ফকৃত গ্রামটিকে পরে বাদশাহকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। হুজুর অধিকাংশ সময় এ খানকায় অবস্থানক করলেও,তবুও মাঝেমধ্যে পাহাড়-জঙ্গলে চলে যেতেন। কারামত প্রকাশ না হওয়ার জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্ট করতেন এবং নিজের কামালিয়াতকে ঢেকে রাখতেন। যেমন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে বললেন,হুজুর,আপনি তো ইউহঈ ওয়া ইউমিতু’(يحي و يميت এমন একটি মকাম,যেখানে কেউ আসীন হলে,আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তিনি মৃতকে জীবিত আর জীবিতকে মৃত করা করতে পারেন) মকামে রয়েছে;এ মরা মাছিগুলোকে জীবিত করে দেখান। হুজুর বললেন,এটা আমার আয়ত্বের বাইরে। তারপর ওই ব্যক্তি মরা মাছিগুলো নিয়ে হযরত শাইখ আহমদ ছরমপুশ আলাইহির রাহমার নিকট গিয়ে শাইখ শরফুদ্দিন মানেরির অপারগতার কথা জানালেন। শাইখ আহমদ ছরমপুশ তাকে বললেন,সুবহানা আল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা শরফুদ্দিন মানেরিকে কামালিয়াত ঢেকে রাখার যে পর্দা বা ক্ষমতা প্রদান করেছেন,তা আমার নেই। তারপর তিনি মরা মাছিগুলোকে বলল,‘উড়ে যাও।তৎক্ষণাৎ এগুলো জীবিত হয়ে উড়ে গেল। এ অবস্থা দেখে ওই ব্যক্তি হুজুরকে বললেন,‘ইউহঈমকাম তথা মরাকে জীবিত করার বিষয়টি দেখেছি। এখন ইউমিতুতথা জীবিতকে মৃত করার মকামটি দেখতে চাই। তদুত্তরে হুজুর বললেন,তা তুমি রাস্তায় দেখবে। ওই ব্যক্তি রাস্তায় গেলে একটি ঘোড়া তাকে এমনভাবে লাথি দিল,যার কারণে সেই মারা গেল। শাইখ শরফুদ্দিন মানেরি খবর পেয়ে ওই ব্যক্তির জানাযা নামাজে শরিক হলেন এবং তার জন্য দোয়া করেন। হযরত শরফুদ্দিন মানেরি প্রচার বিমুখ হওয়াকে কামনা করতেন। যেমন কোন একদিন সমসাময়িক সূফিয়ে কিরামগণ এক মজলিসে উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রত্যেকেই নিজের ইচ্ছা ও কামনার কথা ব্যক্ত করেন। হযরত শরফুদ্দিন মানেরির পালা এলে,তিনি বলেন,আমার কামনা হলো - না এ জগতে আমার নাম প্রচার হওক, না ওই জগতে।’(মিরাতুল আসরার,পৃ.৩০-৩২) তাঁর কশফ অতি প্রখর ছিল। কিন্তু তিনি তা ব্যবহার করতেন না। তবু অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু প্রকাশ পেয়ে যেতো। এ ক্ষেত্রে নি¤œর ঘটনাটি প্রণিধানযোগ্য। শাইখ কাকুরি ও শাইখ আহমদ বিহারি আলাইহিমার রহমাহ দুজন কামিল সূফি ছিলেন। তাঁরা হযরত শাইখ শরফুদ্দিন মানেরিকে ভালোবাসতেন। কোন একদিন শাইখ কাকুরি ও শাইখ আহমদ বিহারি সুলতান ফিরূজ শাহের শাসনামলে দিল্লিতে গেলেন। মস্তি হালতের কারণে তাঁরা বেপরওয়া কথা বার্তা বলেছেন,যার কারণে জাহেরি উলামায়ে কিরাম তাঁদের মৃত্যুদ-ের ফাতাওয়া দিলেন এবং পরে তাঁদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়; অথচ দিল্লিতে তখন অসংখ্য সূফিয়ে কিরাম ছিলেন,যাঁদের একজনও তাঁদের মস্তি হালতকে ওযর হিসেবে দেখিয়ে,তাঁদেরকে বাঁচানো চেষ্টা করেন নি। এ কথা শুনে শাইখ শরফুদ্দিন মানেরি বলেছেন-যে শহরে এ রকম একত্ববাদিদের(সূফিয়ে কিরাম) রক্ত প্রবাহিত হয়,সেটি কতক্ষণ আবাদ থাকতে পারে ?’ এ তাৎপর্যপূর্ণ কালামটি সুলতান ফিরূজ শাহের নিকট পৌঁছালে,সুলতান ফিরূজ শাহ সকল উলামায়ে কিরামকে ডেকে এনে শাইখ শরফুদ্দিন মানেরির তাৎপর্যপূর্ণ কালামটির কথা সবাইকে জানালেন। সকল উলামায়ে কিরাম একমত পোষণ করে বলেছেন যে,আমরা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী ফাতাওয়া দিয়েছি। শরফুদ্দিন মানেরি আলাইহির রাহমাহ এর ইঙ্গিত অনুযায়ী কিছুদিন পর তৈমুর বাদশাহ দিল্লিকে তছনছ করে দিয়েছে। মূলত আউলিয়ায়ে কিরাম লাওহে মাহফুয দেখে বলেন আর যদি লাওহে মাহফুযে কোন কিছু না পান,তাহলে ইলহামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নিকট থেকে জেনে নেন। এ জন্য তাঁদের জ্ঞানই সঠিক জ্ঞান।(মিরাতুল আসরার,পৃ.৯৩২-৯৩৩) শাইখ শরফুদ্দিন মানেরি হাকিকত ও মারিফত বর্ণনার ক্ষেত্রে তুলনাহীন ছিলেন। তাসাউফের ক্ষেত্রে তিনি কাদ্বি আইনুল কুদ্বাত হামদানি আলাইহির রাহমাকে অনুস্মরণ করতেন। এ জন্য তাঁর কিতাবে অনেকবার তাঁর প্রশংসা করেছেন। শাইখ শরফুদ্দিন মানেরি তাঁর মুরিদ এবং খোদা তালাশকারীদের জন্য অনেক আধ্যাত্মিক চিঠি লেখেছেন। তন্মধ্যে হযরত শাইখ মুযাফফর বালাখি আলাইহির জন্য যে চিঠিসমূহ লেখেছেন,তা সূফিদের জন্য আমলের সংবিধান। তাঁর জন্য হুজুর দুশতের বেশি চিঠি লেখেছেন,যেগুলোর মধ্যে আল্লাহর অনেক রহস্যের কথা লেখা রয়েছে। গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে হুজুর শাইখ মুযাফফর বালাখিকে বলে দিয়েছেন যেন এ চিঠিগুলো কাউকে না দেখায়। তিনি এগুলো কাউকে দেখাতেন না। এ কারণে অনেকে এ চিঠিগুলো কপি করে রাখতে ইচ্ছা পোষণ করলেও,হযরত শাইখ মুযাফফর তা দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং এগুলোর উপর মোহর মেরে নিজের নিকট রেখে দিয়েছেন। তিনি অসিয়ত করে গেছেন যে, তাঁর ওফাতের পর এ চিঠিগুলোকে যেন তাঁর কাফনের ভেতর রেখে তাঁকে দাফন করা হয়। তা-ই করা হয়েছে। তবে একটি থলেতে চিঠির একটি বা-িল রয়ে গেছে,যা অদ্যবদি বিভিন্ন কিতাবে বিদৃত হয়েছে।(শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি,আখবারুল আখইয়ার, আকবর বুক সিয়ালরাজ,লাহুর,প্রকাশকাল ২০০৪ইং,পৃ.২৫৬) আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর মকাম ও বিচরণ কতটুকু,তা তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহই প্রমাণ করে। তাসাউফ বিষয়ে তাঁর অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-এক. ইরশাদুস সালিহিন;যা ওয়াহদাতুল ওজুদএর প্রামাণিক গ্রন্থ দুই.শরহু আদাবিল মুরিদিন। এটি শাইখে আকবর মুহিউদ্দিন ইবন আরবি আলাইহির রাহমার কিতাব আদাবুল মুরিদিনগ্রন্থে অদ্বিতীয় ভাষ্যগ্রন্থ। তিন. মাদানুল মায়ানি’;যার মধ্যে শাইখ শরফুদ্দিন মানেরির মলফূযাতসমূহ রয়েছে। চার. মাকতুবাতে সদি। পাঁচ. ইরশাদুত তালেবিন ছয়. লাত্বাইফুল মায়ানি সাত. মুখ্খুল মায়ানি আট. খান পুর নেয়ামত নয়. তুহফায়ে গায়বি দশ. আকাইদে শারফি এগার. যাদ্স্ ুসফর ইত্যাদি। তাঁর চিঠিগ্রলো সূফিয়ে কিরাম ও মুরিদগণ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। এগুলো অধ্যায়নের সময় তাঁরা কারো সাথে সাক্ষাত করতেন না এমনটি কোন বাদশাহের সাথেও নয়। যেমন মাখদুমে জাহানিয়া সাইয়িদ জালালুদ্দিন বুখারি আলাইহির রাহমাহ দিল্লিতে তাশরিফ আনেন। তিনি শাইখ শরফুদ্দিন মানেরির ভক্ত ছিলেন। সুলতান ফিরূজ শাহ হযরত সাইয়িদ জালালুদ্দিন বুখারির ভক্ত ছিলেন। তাই জালালুদ্দিন বুখারি দিল্লিতে আসলে,সুলতান তাঁর সাথে দেখা করার জন্য অনুমতি চেয়েছেন;কিন্তু কয়েক দিন পর্যন্ত অনুমতি না পেয়ে সুলতান খাদেমদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,ব্যাপার কী ? তারা বলেছেন,হুজুরের নিকট শাইখ শরফুদ্দিন মানেরির নিকট থেকে কিছু চিঠি এসেছে,যা অধ্যয়নে তিনি ব্যস্ত এবং এ সময় তিনি হুজরা থেকে বাইরে আসেন না। এ কথা শুনে সুলতান বলেছেন,হুজুরকে স্বীয় স্থান থেকে ডেকে এনে কষ্ট দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই; বরং তাঁকে একাকীই থাকতে দিন। কারণ বুজুর্গদেরকে তাঁদের আপন থেকে সরানো ভালো নয়। (মিরাতুল আসরার,পৃ.৯৩৩;নুজহাতুল খাওয়াতির,খ.২,পৃ.১৪৪) মূলত তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন এতই বিস্তৃত যে,এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তিনি কত উচুঁ মকামের সূফি ও অলি ছিলেন,তা তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ অধ্যায়ন করলেই অনুমান করা যাবে।

গুণাবলীঃ
মানাকিবুল আসফিয়াগ্রন্থকার বলেন,হযরত শরফুদ্দিন মানেরি আলাইহির রাহমার চরিত্র নবির চরিত্রমত। কারণ সূফিয়ে কেরামের চরিত্র নবুয়তের চেরাগদানির নূর থেকে আলোকিত হয়ে থাকে। তাই তাঁর গুণাবলী বলারই বা কী আছে। তবুও তাঁর কয়েকটি গুণাবলী উল্লেখ না করে পারি নি। বদান্যতাই তাঁর স্বভাব। তিনি নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতেন,নিজের কাপড় অন্যকে পরিধানের জন্য দিয়েদিতেন। তিনি কারো দ্বারা কষ্ট পেলে,তিনি কষ্টের দিকে তাকিয়েও দেখতেন না;বরং তিনি অন্যায়কারীর বন্ধু হয়ে যেতেন। তিনি অন্যায়ের প্রতিদান দিতেন হৃদ্যতা দিয়ে ,গালির উত্তর দিতেন দুয়া ও প্রশংসা দিয়ে। দয়ার ক্ষেত্রে তাঁর উপমা সূর্যই,যা নির্বিচারে সকলকে আলো দিয়ে থাকে;(তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত,খ.৩,পৃ.২১২-২১৩) যেভাবে ঐতিহ্যবাহী মাইজভান্ডার দরবার শরিফ থেকে সবাই উপকৃত হয়ে থাকে। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। তিনি কাউকে কষ্ট দিতেন না। তাঁর মানবতা ও উদারতা ছিল তুলনাহীন। যেমন মাইজভান্ডারী একাডেমী কর্তৃত আয়োজিত আর্ন্তজাতিক সূফী সম্মেলনে আগত অতিথি প্রফেসর ড. সাইয়িদ শামীম আহমাদ মুনাইমী তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন,হযরত শরফুদ্দিন মানেরি আলাইহির রাহমাহ একদিন নফল রোজা রেখেছিলেন। ওদিন এক সাধারণ বৃদ্ধা মহিলা একটি মিঠাইয়ের পাত্র হাতে নিয়ে তাঁর খানকায় প্রবেশ করলেন এবং খাদেমদের বলতে লাগলেন,আমি মানত করেছি যে,আমি নিজ হাতে এ মিঠাই হুজুরকে খাইয়ে দেবো। এতে খাদেমরা বাধা দিলে হযরত শরফুদ্দিন মানেরি তাদেরকে বলেন,তাকে ভেতরে আসতে দাও। বৃদ্ধা মহিলাটি ভেতরে এলে,হুজুর তাকে বললেন,আমি হা করেছি,আমাকে খাইয়ে দাও। অতপর মহিলাটি তাঁকে মিঠাই খাইয়ে খুশি মনে চলে গেলে,খাদেমরা হুজুরকে জিজ্ঞেস করল,সামান্য একজন মহিলার অনুরোধে আপনি কেন আপনার মূল্যবান রোজা ভঙ্গ করলেন ? জবাবে তিনি বললেন,রোজা ভঙ্গ করলে কীভাবে এর কাযা বা কাফফারা আদায় করতে হয়,তা আমার জানা আছে;কিন্তু একজন মানুষের মন ভেঙ্গে দিলে, কীভাবে এর কাযা বা কাফফারা আদায় করতে হয়,তা আমার জানা নেই। আল্লামা মুনইমী বিভিন্ন সূফিদের এ ধরণের আরো কতিপয় ঘটনা উল্লেখ করে মন্তব্য করেন,প্রকৃতপক্ষে এভাবে সূফিয়ে কিরাম মানুষের মন জয় করে ভারত উপমহাদেশ তথা পুরো বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।

ওফাতঃ
হযরত শরফুদ্দিন আহমদ মানেরি আলাইহির রাহমার বুধবার ফজরের নামাজের পর বালিশের সাথে হেলান দিয়ে জানামাজের উপর বসে থাকতেন। লাগাতার কয়েক রাত ধরে তাঁর খেদমতের জন্য তাঁর সহোদর ভাই শাইখ জলিল উদ্দিন এবং সম্মানিত খাদেমগণ যেমন কাজি শামশুদ্দিন,মাওলানা শিহাবুদ্দিন,মাওলানা ইবরাহিম প্রমুখ আলাইহির রাহমাহ জেগে থাকতেন। উপবিষ্ট অবস্থায় তিনি হঠাৎ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আজিমপড়লেন। তারপর খাদেমদেরকে বললেন,তোমরাও এটি পড়। তাঁরা সবাই এটি পড়েছেন। অতপর হুজুর একটু মৃদু হেসেছেন এবং বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন সুবহানাল্লাহ। এ অভিশপ্ত শয়তান এখনো আমাকে তাওহিদের মাসয়ালায় সংশয়ে ফেলতে চায়। আল্লাহ তায়ালার অপার কৃপা ও দয়ার কারণে সে আমার মনোযোগও আকর্ষণ করতে পারে নি। যেন পাগলেন অর্থহীন কীর্তন গেয়ে চলে গেল। তারপর তিনি পুনরায় লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আজিমপড়তে শুরু করেন এবং উপস্থিত সকলকেও সেটি পড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। তারপর তিনি তাঁর নিজস্ব দুয়া দরুদ এবং অযিফা পাঠে মশগুল ছিলেন চাশত পর্যন্ত। এরপর আল্লাহর প্রশংসার লিপ্ত হয়ে গেলেন এবং বারংবার বলতে লাগলেন আলহামদু লিল্লাহ’,আল-মিন্নাতু লিল্লাহ। এরপর তিনি হুজুরা শরিফের বাইরে এসে বললেন। একটু পর তাঁর হাত মোবারক মুসাফাহা করার জন্য প্রশস্ত করে মেলে ধরলেন । তিনি প্রথমে তাঁর হাতের উপর হযরত কাযি শামশুদ্দিনের হাত দীর্ঘক্ষণ রাখলেন। তারপর তাঁর হাত ছেড়ে দিলেন। এরপর তিনি কাজি যাহেদের হাত টেনে দিয়ে তাঁর বুকের উপর রেখে বলেছেন,আমরাতোই ঐ, আমরাতোই ঐ । তিনি এ বাক্যটি কয়েকবার বলার পর বললেন,আমরাতো ঐ পাগল, আমরাতো ঐ পাগল; তিনি পুনরায় বললেন-আমরা তা নই,বরং আমরা ঐ পাগলদের জুতোর মাটি। তারপর উপস্থিত সকলের দাঁড়িতে চুমু দিয়ে সকলকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের কামনায় থাকার জন্য বলে এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন-তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সকল পাপ মাপ করে দেন।তারপর তিনি তাঁর একনিষ্ট খলিফা হযরত শাইখ মুজাফ্ফর ,মাওলানা নসির উদ্দিনসহ অসংখ্য খলিফার সাথে সাক্ষাৎ করে রূহানী আদান-প্রদান শেষ করেন। একই দিনের মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর কিছু দুয়া দরূদ ও অযিফা পাঠ করেছেন।(তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত,খ.৩,পৃ.২২৬-২৩৭) 

ওফাতের পূর্বে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, আপনার খলিফা ও মুরিদদের থেকে কে আপনার জানাযার নামাজ পড়াবেন ? তিনি বলেছেন,আগামীকাল এক বিশুদ্ধ বংশদ্ভেুাত, সাইয়িদ,হাফেযে কুরআন,দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তি আসছেন,যাঁর নাম হযরত মির সাইয়িদ আশরাফ জাহাঙ্গির সিমনানি। তিনি আমার জানাযার নামাজের ইমামতি করবেন। 

হযরত শরফুদ্দিন আহমদ মানেরি আলাইহির রাহমার ৫/৬ শাওয়াল,বৃহস্পতিবার মতান্তরে বুধবার ৭৮২ মতান্তরে ৭৫৬ হিজরিতে ওফাত লাভ করেন। ওফাতে পর তাঁকে কাফন পরিয়ে তৈরি করে রেখেছেন,যাতে ইমাম এসে জানাযার নামাজ আদায় করতে পারেন।(নুজহাতুল খাওয়াতির,খ.২,পৃ.১৪৩; ইসমাইল বাগদাদি,‘হাদিয়াতুল আরেফিন’,দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরবি,বৈরুত,খ.১ম,পৃ.৪৪১) অছিয়ত অনুযায়ী হযরত সাইয়িদ আশরাফ জাহাঙ্গির সিমনানি আলাইহির রাহমাহ যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে তাঁর জানাযা নামাজের ইমামতি করেছেন। তাঁকে দাফন করার পর হঠাৎ করেই তাঁর হাত মোবারক কবরের ভেতর থেকে উপরে উঠে গেল। সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কী ব্যাপার ? সবাই হযরত আশরাফ জাহাঙ্গির সিমনানির নিকট এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে,তিনি আধ্যাত্মিকভাবে হযরত শরফুদ্দিন মানেরির কাছ থেকে জেনে নিয়ে বলেছেন,হুজুর তোমাদেরকে অসিয়ত করেছিলেন যেতাঁর সাথে ঐ তাজকেও যেন দাফন করা হয়,যেটি তিনি রাজগিরের পাহাড়ে রিজালুল গাইবের পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা তা ভুলে গেছো। তাজটি এনে হাতে দেয়ার সাথে সাথে তাজসহ হাত মোবারক কবরে ঢুকে গেল।(মিরাতুল আসরার,পৃ.৯৩৪)


[লেখক: মুহাম্মদ রবিউল আলম, প্রভাষক,আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা,চট্টগ্রাম]